অক্টোবর ২, ২০২০,১:১০ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক : সময় লেগেছে তিন দশক। ছিল সাড়ে আটশো সাক্ষী। দেখা হয়েছে সাত হাজারের বেশি দলিলপত্র, ছবি আর ভিডিও টেপ । এত কিছুর পর ভারতের একটি আদালত ষোড়শ শতকের একটি মসজিদ ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য কাউকে দোষী বলে খুঁজে পায়নি। পবিত্র নগরী অযোধ্যায় এই মসজিদটিতে হামলা চালিয়েছিল উচ্ছৃঙ্খল হিন্দু জনতা।
এই মামলায় যে ৩২ জন জীবিত অভিযুক্ত, তাদের মধ্যে ছিলেন সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী এল কে আদভানি এবং আরও অনেক সিনিয়র বিজেপি নেতা। বুধবারের রায়ে এদের সবাইকে খালাস দেয়া হয়েছে। আদালত বলেছে, ১৯৯২ সালে এই মসজিদটি ধ্বংস করেছে অচেনা ‘সমাজ-বিরোধীরা’ এবং এই হামলা পূর্ব-পরিকল্পিত ছিল না।
মসজিদটি ধ্বংস করতে সময় লেগেছিল মাত্র চার ঘন্টা। এই কাজটি করা হয়েছে হাজার হাজার মানুষের চোখের সামনে। এটি ধ্বংসের আগে যে এই কাজের মহড়া দেয়া হয়েছে, এতে যে স্থানীয় পুলিশের প্রচ্ছন্ন সম্মতি ছিল এবং হামলাকারীদের যে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছিল – এমন বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ দিয়েছেন অনেক প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। তবে তারপরও আদালত এরকম রায় দিয়েছে।
গত বছর ভারতের সুপ্রিম কোর্টও বলেছিল, এটি ছিল এক ”সুপরিকল্পিত ঘটনা” এবং ”আইনের শাসনের এক গুরুতর লঙ্ঘন”।
তাহলে অভিযুক্তরা যে খালাস পেলেন এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে?
সাধারণভাবে এই রায়কে দেখা হচ্ছে ভারতের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা কতটা ঢিমে-তালের এবং বিশৃঙ্খলাপূর্ণ- তারই আরেকটা নজির হিসেবে। অনেকের আশংকা, কয়েক দশক ধরে বিচার বিভাগের ওপর যেরকম নগ্ন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ চলেছে, প্রয়োজনীয় তহবিল দেয়া হয়নি এবং এর সক্ষমতা দুর্বল করা হয়েছে, তাতে এটিকে আর সংস্কার করা সম্ভব নয়।
কিন্তু এই রায় একই সঙ্গে আরেকটি বিষয়ের ওপর তীব্র আলোকপাত করেছে- সেটি হচ্ছে কীভাবে ভারতের ২০ কোটি মুসলিমকে ক্রমশই এক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হচ্ছে।
ভারতে নরেন্দ্র মোদীর হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির শাসনে মুসলিমদের কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়া যে দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ গণতন্ত্র বলে কথিত, তার বহুত্ববাদী এবং ধর্মনিরপেক্ষ ইতিহাসের যে কোন সময়ের চেয়ে মুসলিমরা এখন ভারতে নিজেদের অনেক বেশি অপমানিত বলে মনে করে।
গরুর মাংস খাওয়ার কারণে কিংবা গাড়িতে গরু নিয়ে যাওয়ার কারণে মুসলিমদের পিটিয়ে হত্যা করেছে উন্মত্ত জনতা। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের কাছে গরু এক পবিত্র প্রাণী।
মিস্টার মোদীর সরকার আইনে দ্রুত গতিতে এমন সব সংস্কার এনেছে, যাতে করে প্রতিবেশি দেশগুলোর অমুসলিমরা ভারতে আশ্রয় পায়। ভারতের মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু এবং কাশ্মীর তারা কয়েক টুকরো করে ভেঙ্গে দিয়েছে। সাংবিধানিক স্বায়ত্বশাসন হরণ করেছে।
এবছর একটি মুসলিম ধর্মীয় গোষ্ঠী দিল্লিতে এক ধর্মীয় সমাবেশের আয়োজন করার পর করোনাভাইরাস ছড়ানোর জন্য কেবল মুসলিমদের ওপরই দোষ চাপানো হয়। মহামারির মধ্যে যখন হিন্দুদের বড় ধর্মীয় সমাবেশ হয়েছে, সেটিকে কিন্তু একই রকমের নিন্দা আর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়নি গণমাধ্যম বা রাজনীতিকদের কাছ থেকে, একইভাবে দোষ চাপানোর চেষ্টাও চোখে পড়েনি।
এখানেই শেষ নয়। গত শীত মৌসুমে বিতর্কিত এক নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে দাঙ্গায় উস্কানি দেয়ার কথিত অভিযোগে মুসলিম ছাত্র আর কর্মীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, জেলে ঢোকানো হয়েছে। অথচ দাঙ্গায় উস্কানি দেয়া অনেক হিন্দু মুক্তভাবে ঘুরে বেড়িয়েছে।
অনেক মুসলিমের মতে, ভারতে মুসলিমদের যেভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে, বাবরি মসজিদের ঘটনার রায় আসলে তারই ধারাবাহিকতা মাত্র।
ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে এই বিচ্ছিন্নতার বোধ একেবারেই বাস্তব। মিস্টার মোদীর দল তাদের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরের আদর্শ নিয়ে কোন রাখ-ঢাক করে না। জনপ্রিয় টেলিভিশন নিউজ চ্যানেলগুলো প্রকাশ্যেই মুসলিমদের দানবরূপে চিত্রিত করার কাজ চলে। ভারতের এক সময়ের অনেক শক্তিশালী আঞ্চলিক দল, যারা তাদের জনগণের পাশে দাঁড়াতো, তারাও যেন মনে হচ্ছে মুসলিমদের পরিত্যাগ করেছে।
প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সমালোচকরা বলেন, এরা কেবল ভোটের স্বার্থে মুসলিমদের ব্যবহার করে, বিনিময়ে তাদের কিছু দেয় না। আর মুসলিম সম্প্রদায়ের নিজেদেরও এমন নেতা কমই আছেন, যারা তাদের হয়ে কথা বলবে।
“মুসলিমরা এই পুরো ব্যবস্থার ওপর তাদের বিশ্বাস হারাচ্ছে। তাদের মনে হচ্ছে তারা কোণঠাসা হয়ে গেছে এবং রাজনৈতিক দলগুলো, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম- কেউই আসলে মুসলিমদের জন্য কিছু করছে না”, বলছেন দিল্লি ভিত্তিক একটি গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের’ গবেষক আসিম আলি।
সত্যি কথা বলতে কী, ভারতে মুসলিমদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠিতে পরিণত করার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। একটি রিপোর্টে বলা হচ্ছে, ভারতে মুসলিমদের একই সঙ্গে দুটি বোঝা বইতে হচ্ছে। একদিকে তাদের ”দেশ বিরোধী” বলে তকমা দেয়া হয়, আবার একই সঙ্গে বলা হয় ভারতে ”মুসলিম তোষণ” চলছে।
কিন্তু ইতিহাসবিদরা বলছেন, এখানে পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, মুসলিমরা অন্যায্য সুবিধে পাচ্ছে- হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের এরকম কথা অনেক ভারতীয় বিশ্বাস করছে। বাস্তবে ভারতের মুসলিমরা কোন ধরণের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি অর্জন করেনি।
ভারতের বড় বড় নগরীগুলিতে মুসলিমদের ক্রমাগত বেশি হারে কিছু নির্দিষ্ট মহল্লায় ঠেলে দেয়া হচ্ছে। ভারতের সবচেয়ে সুসজ্জিত পুলিশ বাহিনী, ফেডারেল পুলিশ বাহিনীতে ২০১৬ সালে মুসলিম পুলিশ অফিসার ছিল ৩ শতাংশেরও নীচে। অথচ মুসলিমরা ভারতের মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ।
একটি রিপোর্টে বলা হয়, ভারতের শহুরে মুসলিম জনগোষ্ঠির মাত্র ৮ শতাংশ এমন কাজ করেন যেখানে নিয়মিত বেতন মেলে। এটি ভারতের জাতীয় গড় হারের তুলনায় অনেক কম।
প্রাথমিক স্কুলগুলোতে মুসলিম শিশুদের ভর্তির হার যদিও বেশ উঁচু, কিন্তু হাইস্কুলে যেতে যেতে এরা ঝরে পড়ে। এর মূল কারণ অর্থনৈতিক বঞ্চনা। ভারতের পার্লামেন্টে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব ক্রমাগত কমছে। পার্লামেন্টের নির্বাচিত নিম্নকক্ষে এখন মুসলিম সদস্য ৫ শতাংশের নীচে। অথচ ১৯৮০ সালে এটি ছিল ৯ শতাংশ।
২০১৪ সালে যখন বিজেপি ক্ষমতায় এলো, তখন তাদের একজনও মুসলিম এমপি ছিল না। ভারতের ইতিহাসে একজনও মুসলিম এমপি ছাড়া কোন দলের ক্ষমতায় আসার সেটাই প্রথম ঘটনা।
মিস্টার মোদী এবং তার দলের নেতারা সবসময় দাবি করে চলেছেন যে তারা কোন ধর্মের বিরুদ্ধে বৈষম্য করেন না। প্রধানমন্ত্রী মোদী বলে থাকেন, তার পেছনে অনেক মুসলিম দেশের সমর্থন আছে। তার সরকারের যে ব্যাপক জনকল্যাণ কর্মসূচি, সেটির সুফল সব দরিদ্র ভারতীয়ের কাছেই পৌঁছাচ্ছে। তারা যে জাতের বা যে ধর্মের মানুষই হোক না কেন।
বিজেপি বরং উদারপন্থী বিরোধী দলগুলোকে ”ধর্মনিরপেক্ষতার ভেকধারী” বলে বর্ণনা করে থাকে।
অনেকে মনে করেন, বিজেপির এই অভিযোগ কিছুটা সত্য। এর উদাহারণ হিসেবে তারা কমিউনিস্টদের দিকে ইঙ্গিত করেন, যারা তিন দশকের বেশি সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেছে। কমিউনিস্টরা স্পষ্টভাষায় নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করে। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ হচ্ছে মুসলিম। কমিউনিস্টরা তাদের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিয়েছিল।
অথচ গবেষণায় দেখা গেছে, গুজরাটের মুসলিমরা অর্থনৈতিকভাবে এবং মানব উন্নয়ন সূচকে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিদের তুলনায় অনেক ভালো অবস্থানে আছে। যদিও গুজরাটে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চলে, সেখানে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছে উত্তেজনা।
তবে ভারতের আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক মির্জা আসমের বেগ এটিকে ব্যাখ্যা করছেন এভাবে, “ভারতের বাজার অর্থনীতির কোন ধর্ম নেই। কাজেই গুজরাটের মতো রাজ্য, যেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য বেশ ভালো, সেখানে হিন্দু এবং মুসলিম, উভয়েই ভালো উপার্জন করছে।”
কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, বিজেপি যে ধরণের ধর্মভিত্তিক নির্বাচনী রাজনীতির চর্চা করে, তাতে করে মুসলিমদের ”আলাদাকরণ” করা হয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ক্রিস্টোফে জাফরেলট বলেন, “কিভাবে আপনি মেরুকরণের কাজটা করবেন? এটা আপনি করবেন অন্যদেরকে আপনার পরিচয়ের প্রতি একটা হুমকি হিসেবে চিত্রিত করে।”
ক্রিস্টোফে জাফরেলটের মতে, ভারত এখন এক ধরণের ”এথনিক ডেমোক্রেসির” দিকে যাচ্ছে, যা এথনিক জাতীয়তাবাদ থেকে উৎসারিত। এর মূলে আছে একধরণের ”শ্রেষ্ঠত্বের” বোধ।
তবে সবকিছু এখনো অন্ধকারে হারিয়ে যায়নি। এক তরুণ মধ্যবিত্ত গোষ্ঠির উত্থান ঘটছে, দেশভাগের ভূত যাদের ঘাড়ে চেপে নেই। নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে যে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছিল, তখন সেখানে এই তরুণ, স্পষ্টভাষী মুসলিম নারী-পুরুষদের দেখা গেছে ভারতের রাস্তায়। ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায় এক ঘরকুনো এবং নির্বাক সংখ্যালঘু বলে যে গৎবাঁধা ছবি, সেটা তারা ভেঙ্গে দিয়েছে।
এলাকায় এলাকায় এখন গড়ে উঠেছে কমিউনিটি কোচিং ক্লাস। সেখানে তরুণ মুসলিমদের ভারতের মর্যাদাপূর্ণ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জহির আলি বলছেন, ভারতের অনেক তরুণ মুসলিম এখন তাদের মুসলিম পরিচয়কে ইতিবাচক হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা তাদের মত প্রকাশে মোটেই কুন্ঠিত নয়।
কিন্তু তার মতে, শেষ পর্যন্ত বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মামলায় অভিযুক্তদের খালাস দেয়ার এই ঘটনা ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে উৎকন্ঠা এবং অবিচারের বোধ আরও গভীর করবে।
“অনেক দিক থেকেই, এটা আসলে পুরো সম্প্রদায়কে পরিত্যাগ করার সামিল। তাদের মধ্যে একধরণের ‘ক্ষমতাহীনতার’ বোধ তৈরি হচ্ছে। বহু বছর ধরে মুসলিমদের তাদের নিজেদের সম্প্রদায়ের নেতারা, হিন্দু নেতারা এবং সব রাজনৈতিক দল কেবল নিজস্ব স্বার্থে ব্যবহার করেছে। দারিদ্র তাদের অবস্থাকে আরও শোচনীয় করে তুলেছে”, বলছেন তিনি। সূত্র : বিবিসি বাংলা।
Site Developed By: Md. Shohag Hossain